কান্তনগর মন্দির

কান্তনগর মন্দির (কান্তজীউ মন্দির হিসেবেও পরিচিত) বাংলাদেশের প্রাচীন স্থাপত্য নিদর্শনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কারুকার্যময়। দিনাজপুর শহর থেকে ১২ মাইল উত্তরে ঢেপা নদীর তীরে, কান্তনগর গ্রামে অবস্থিত এ প্রাচীন মন্দিরটি নির্মাণ করেন মহারাজা প্রাণনাথ ও তার পূত্র মহারাজা রামনাথ।

বাংলার স্থাপত্য সমূহের মধ্যে বিখ্যাত এ মন্দিরটির বিশিষ্টতার অন্যতম কারণ হচ্ছে পৌরাণিক কাহিনী সমূহ পোড়ামাটির অলঙ্করণে দেয়ালের গায়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এ নবরত্ন বা ‘নয় শিখর’ যুক্ত হিন্দু মন্দিরের চূড়া হতে আদি নয়টি শিখর ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশের সর্বোৎকৃষ্ট টেরাকোটা শিল্পের নিদর্শন রয়েছে এ মন্দিরে।

১৭২২ সালে মন্দিরের নির্মাণ কাজ শুরু করেন দিনাজপুরের মহারাজা প্রাণনাথ রায় যদিও নির্মাণ কাজ শেষ হয় তার পোষ্যপুত্র রামনাথ রায় কর্তৃক ১৭৫২ সালে।

শুরুতে মন্দিরের চূড়ার উচ্চতা ছিল ৭০ ফুট। ১৭৫২ সালে মন্দিরটি উৎসর্গ করা হয়।

১৮৯৭ সালে মন্দিরটি ভূমিকম্পের কবলে পড়লে এর চূডাগুলো ভেঙে যায়। মহারাজা গিরিজানাথ মন্দিরের ব্যাপক সংস্কার করলেও মন্দিরের চূড়াগুলো আর সংস্কার করা হয়নি।( কিছু মানুষের ধারনা মন্দিরটি ১রাতে তৈরী হয়েছিল )। মন্দির প্রাঙ্গণ আয়োতাকার হলেও, পাথরের ভিত্তির উপরে দাঁড়ানো ৫০ফুট উচ্চতার মন্দিরটি বর্গাকার। মন্দিরটি তিন তলা বিশিস্ট। প্রতিটি তলার চারপাশে বারন্দা ‌রয়েছে। মন্দিরের বাইরের দেয়াল জুড়ে পোড়ামাটির ফলকে দেবমূর্তির ছবি খোদাই করা রয়েছে যা রামায়ণ, মহাভারত এবং বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনীর কথা বর্ণনা করে। মন্দিরের পশ্চিম দিকের দ্বিতীয় বারান্দা থেকে সিঁড়ি উপরের দিকে উঠে গেছে। মন্দিরের নিচতলায় ২৪টি,দ্বিতীয় তলায় ২০ টি এবং তৃতীয় তলায় ১২টি দরজা রয়েছে। যতনের অভাবে মন্দিরটি বিলুপ্তির পথে।

একনজরে মন্দিরটির তথ্য:

নির্মাণকারী: রাজা রামনাথ
সময়কাল: ১৭৫২
প্রধান দেবতাঃ কৃষ্ণ
স্থাপত্যঃ নবরত্ন
অবস্থানঃ ঢেপা নদীর তীরে, কান্তনগর

কান্তনগর মন্দিরের বিস্তারিত:

মন্দিরের নির্মান তারিখ নিয়ে যে সন্দেহ ছিল তা অপসারিত হয় মন্দিরের পূর্বকোণের ভিত্তি দেয়ালের সঙ্গে সংযুক্ত সংস্কৃত ভা্ষার লেখা কালানুক্রম জ্ঞাপক একটি শিলালিপি থেকে। সূত্র অনুযায়ী দিনাজপুরের মহারাজ প্রাণনাথে ১৭২২ সালে এ মন্দিরের নির্মাণ কাজ শুরু করেন এবং তাঁর স্ত্রী রুকমিনির আদেশে পিতার ইচ্ছার পূরণ করার জন্য মহারাজের দত্তকপুত্র মহারাজ রামনাথ ১৬৭৪ শকে (১৭৫২ সালে) এ মন্দিরটির নির্মাণ সম্পন্ন করেন। যাহোক, বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে মহারাজা গিরিজানাথ বাহাদুর ধ্বংস হয়ে যাওয়া নয়টি শিখর বাদে মন্দিরটির ব্যাপক পূনর্গঠন করেছিলেন।

এ জমকালো পিরামিড আকৃতির মন্দিরটি তিনটি ধাপে উপরে উঠে গিয়েছে এবং তিন ধাপের কোণগুলির উপরে মোট নয়টি অলঙ্কৃত রথ দাড়িয়ে আছে। মন্দিরের চারদিকে খোলা খিলান পথ রয়েছে যাতে যে কোন দিক থেকেই পূজারীরা ভেতরের পবিত্র স্থানে রাখা দেবমূর্তিকে দেখতে পায়।

৫২’-0″ আয়তনের বর্গাকৃতির মন্দিরটি একটি আয়তাকার প্রাঙ্গনের (২৪০’×১২০”) উপর স্থাপিত। এর চারদিকের রয়েছে পূজারীদের বসার স্থান যা ঢেউটিন দ্বারা আচ্ছাদিত। বর্গাকার প্রধান প্রকোষ্ঠটিকে (১0′-৩” প্রান্তের পরিমাণ) কেন্দ্র সম্পূর্ণ ইমারত নির্মিত হয়েছে। ৩’-৩” পাথরের ভিত্তির উপর দাঁড়ানো মন্দিরটির উচ্চতা ৫০ ফুটেরও বেশি। ধারণা করা হয়, গঙ্গারামপুরের (দিনাজপুর) নিকট বাননগরের প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ থেকে নির্মাণ উপকরণ এনে এটি তৈরি করা হয়েছিল। বাইরের দিকে উঁচু করে তৈরী তিনটি চতুষ্কোণাকার প্রকোষ্ঠটিকে শক্তিশালী করেছে, তাই উপরের বিরাট চূড়াটিকে এ প্রকোষ্ঠটির পক্ষে ধারণ করা সম্ভব হয়েছে। বর্তমানে ধ্বংস প্রাপ্ত বাকি আটটি অলংকৃত চূড়া নিচের দূতলা ছাদের আটটি কোণে সংযোজন করা হয়েছিল। নিচতলার বাঁকা কার্নিস কোণগুলিতে এসে ঝুলে আছে, এর মধ্যভাগ কিছুটা উঁচু হওয়ার ভিত্তি থেকে এর উচ্চতা দাড়িয়েছে ২৫ ফুট, যার দ্বিতীয় তলার উচ্চতা ১৫ ফুট এবং তৃতীয় তলা ৬ ফুট ৬ ইঞ্চি। নিচের চারকোণের প্রত্যেকটির সাথে একটি করে ছোট প্রকোষ্ঠ রয়েছে এবং এগুলি দ্বিতীয় তলার উপরে স্থাপিত কারুকার্যখচিত অষ্টকোণাকৃতির কোণের বুরুজগুলির ভার বহন করছে। নিচ তলার প্রার্থনা ঘরের চারদিকে মন্দিরে মোট চারটি আয়তাকার বারান্দা রয়েছে। এগুলির পরিমাণ ৩’০-৮”×৫’০” এবং ১৫’-৬”×৪’-৪”।

নিচতলার প্রত্যেকদিকের প্রবেশপথে বহু খাঁজযুক্ত খিলান রয়েছে। সমৃদ্ধ অলঙ্করণ যুক্ত দুটি ইটের স্তম্ভ দ্বারা প্রতিটি খিলানকে পৃথক করা হয়েছে। নিচতলার চার প্রকোষ্ঠের বাইরে মোট ২১টি খিলান দরজা আছে, আর দ্বিতীয় তলার এ খিলান দরজার সংখ্যা ২৭টি। ছোট হয়ে আসা তৃতীয় তলার মাত্র তিনটি প্রবেশ দরজা এবং তিনটি জানালা রয়েছে। পশ্চিমের দিকের দ্বিতীয় বারান্দার থেকে ২’-৩” প্রশস্ত সংকীর্ণ সিঁড়ি পথ উপরে উঠে গিয়েছে। অন্ধকারাচ্ছন্ন এ প্রবেশ পথে এঁকে বেঁকে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় উঠে গিয়েছে।

পূজারীদের চালার বাইরে প্রধান মন্দিরের প্রায় একশগজ দূরে আগাছায় ছাওয়া একটি চূড়া বিশিষ্ট ছোট ধ্বংসপ্রান্ত মন্দির রয়েছে। প্রচলিত ধারনা মতে মহারাজ প্রাণনাথ ১৭০৪ সালে এ মন্দিরটি তৈরী করে এখানে কৃষ্ণের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। একটি সাময়িকভাবে বৃন্দাবন থেকে আনা হয়েছিল। নবরত্ন মন্দির তৈরি সমাপ্ত হলে এ মূর্তিটি এখানে স্থানান্তর হয়। এটি এখন একটি পরিত্যক্ত দেবালয়। এ মন্দিরটি ছিল ১৬ পার্শ সম্বলিত সৌধ এবং এর ‍উচ্চতা ছিল ৪০ ফুট এবং এর দক্ষিণ দিকে প্রবেশ পথে ছিল বহু খাঁজ বিশিষ্ট খিলান।

পোড়ামাটির অলঙ্করণ ভিত্তি থেকে শুরু করে মন্দিরে চূড় পর্যন্ত ভেতরে ও বাইরে দেয়ালের প্রতিটি ইঞ্চিতে তিনটি পৌরাণিক কাহিনীর অনুসরণে মনুষ্য মূর্তি ও প্রাকৃতিক বিষয়াবলি বিস্ময়কর ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। মহাভারত ও রামায়ন এর বিস্তৃত কাহিনী এবং অসংখ্য পাত্রপাত্রীর বিন্যাস ঘটেছে এখানে। কৃষ্ণর নানা কাহিনী, সমকালীন সমাজ জীবনের বিভিন্ন ছবি এবং জমিদার অভিজাতদের বিনোদনের চিত্র প্রতিভাত হয়েছে। পোড়ামাটির এ শিল্পগুলির বিস্ময়কর প্রাচুর্য, মূর্তির গড়ন কোমল ভাব ও সৌন্দর্য এত যত্নের সাথে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যে, বাংলার কোন ম্যূরাল চিত্রের চেয়ে তা অনেক উৎকৃষ্ট। কেউ যদি মন্দির দেয়াল অনুকরণের দৃশ্য যে কোন দিক থেকে গভীর মনোযোগের সাথে দেখেন এবং বিষয় বস্তুকে সমন্বিত করেন তাহলে এর বিষয় বৈচিত্র্য দেখে অবাক বিস্ময়ে আবিভূত হবেন।

মন্দিরের বাইরের দেয়ালের পোড়ামাটির অলঙ্করণের সাধারণ যে চিত্র তাতে চারদিকের ভিত্তি প্যানেলের নিম্নাংশে চিত্রগুলি সদমান্তরাল ভাবে চারটি প্রবেশ পথের দিকে এগিয়ে গিয়েছে। এ দিক থেকে ভিত্তির একটু উপরেই ক) লতাপাতার মধ্যে প্রস্ফুটিত গোলাপ এবং এর বিকল্প হিসেবে কোথাও চারটি ধাতুর পাতে ধাতব প্রলেপযুক্ত ডিজাইন, খ) স্তম্ভের কার্নিসে যে প্রতিকৃতি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে তার মধ্যে সমসাময়িক সামাজিক চিত্র ও মাটির খন্ডে তৈরী অভিজাদ জমিদারদের শিকারের দৃশ্য প্রস্ফুটত হয়েছে, গ) উপরের সমান্তরাল প্যানেলে সূক্ষ্ম জটিল অলঙ্করণের মাঝে প্রস্ফুটিত গোলাপ ছিল যা সাধারণভাবে ষাটগম্বুজ মসজিদ, বাঘা মসজিদ, কুসুম্বা মসজিদ ও ছোট সোনা মসজিদ প্রভৃতির গায়ে লক্ষ করা যায়।

দ্বিতীয় পর্যায়ের অলঙ্করণের উজ্জ্বল নিদর্শনসমূহ হচ্ছে বনের ভেতর শিকার দৃশ্য, হাতি ঘোড়া, উট সহযোগে রাজকীয় শোভাযাত্রা এবং অভিজাতদের জন্য চমৎকার ভাবে তৈরী গরুর গাড়ী । তাদের গায়ে ছিল মুগর পোষাক ও অস্ত্র। সুন্দরভাবে সজ্জিত হাতি এবং ঘোড়া ও এদের সঙ্গে যুক্ত রথসমূহ কারুকার্য সমৃদ্ধ ছিল। অলংকৃত পালকিতে গুটি সুটি মেরে বসে থাকা নাদুস নুদুস দেহের জমিদার, হাতে তার বিলসী হুক্কা। হুক্কার অন্যদিকে লম্বা নল থেকে ধূঁয়ার কুন্ডুলি ছুড়েছেন; অন্যদিকে নদীর দৃশ্য রয়েছে, যেখানে লোকজনে ঠাসা সরু লম্বা নৌকায় সকলে আনন্দোৎসবে মগ্ন।

Scroll to Top